গত বছরের ১৯ জুলাই দেশজুড়ে ছিল কারফিউ। এদিন থমথমে ছিল বগুড়া শহর। এক দিন আগে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের কয়েক শ রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনায় উত্তাল ছিল গোটা শহর। গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন অর্ধশত মানুষ। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা।
গুলি-হামলার প্রতিবাদে দুপুরের পর কারফিউ ভেঙে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন তাঁরা। বেলা তিনটার দিকে শহরের সাতমাথা-তিনমাথা সড়কের সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে ছাত্র-জনতা জ্বালিয়ে অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে।
ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং শটগানের গুলিবর্ষণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষ আর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে ঘণ্টাব্যাপী। ওই সময় গুলিবিদ্ধ হয় অনাথ সিয়াম শুভ (১৬)। এলোপাতাড়ি ছোড়া ছররা গুলিতে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়। শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পর দিন পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।
গত বছরের জুলাই আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থানে বগুড়ায় শহীদ হন ১৬ জন। এর মধ্যে প্রথম শহীদ সিয়াম শুভ। সিয়াম বগুড়া শহরের হাড্ডিপট্টি এলাকার বাসচালক মো. আশিক ও শাপলা বেগমের পালিত সন্তান। সিয়ামের জন্ম বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার হাটকড়ই এলাকার দরিয়াপুর গ্রামে। তার বাবা বাবু মিয়া এবং মা আয়েশা বেগম কেউ বেঁচে নেই।
সাত বছর বয়সে বগুড়া শহরে এসে হারিয়ে যায় সিয়াম। এরপর রেলস্টেশন এলাকায় শিশুটিকে কুড়িয়ে পান হাড্ডিপট্টি এলাকার শাপলা বেগম। শাপলা-আশিক দম্পতির ঘরেই বেড়ে ওঠে সিয়াম। বাবা আশিকের সঙ্গে কখনো কখনো বাসচালকের সহকারীর কাজ করত সে। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের ১৯ জুলাই কারফিউ জারির কারণে বাস বন্ধ ছিল। ঘরে চাল না থাকায় হাড্ডিপট্টি এলাকার একটি ভাঙাড়ির দোকানে কাজ করতে যায় সিয়াম। ফাঁক দিয়ে বাড়িতে এসে চলে যায় মিছিলে। এরপর শহরের স্টেশন সড়কের সেউজগাড়ি পালপাড়া মন্দির এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সে। ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হয় তার মাথা, চোখ,মুখ, বুক, পেট, ঊরু, হাঁটুসহ গোটা শরীর।
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ ও মৃত অবস্থায় সিয়াম নামের শিশুকে হাসপাতালে আনা হয়।
বগুড়া শহরের রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন হাড্ডিপট্টি বস্তিতে গত শুক্রবার কথা হয় সিয়ামের পালক বাবা মো. আশিক ও মা শাপলা বেগমের সঙ্গে। শাপলা বেগম বলেন, ‘সাত বছর বয়সে বগুড়া শহরে এসেছিল সিয়াম শুভ। এক সন্ধ্যায় বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। পরিবারের কথা ঠিকমতো বলতেও পারছিল না। পরে অনাথ সিয়ামকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে লালন–পালন করি। আমার দুই সন্তানের সঙ্গে সে–ও বেড়ে ওঠে।’
গুলিবিদ্ধ হয়ে সিয়ামের মারা যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শাপলা বেগম বলেন, ‘বাসে বাবার সঙ্গেই হেলপারের কাজ করত। সেদিন (১৯ জুলাই) কারফিউ ছিল। তারও এক দিন আগে থেকে গাড়ির চাকা বন্ধ। বাবা-ছেলের কামাই নেই। ঘরে ভাতের চাল নেই। সিয়াম বিয়ানবেলা হাড্ডিপট্টি এলাকার একটি ভাঙারির দোকানে কাজ করতে যায়। দুপুরে এলাকার একটি মিলাদের খিচুড়ি খেয়ে বাড়ি আসে। বিকেলে বাড়ি থেকে ১৩ বছরের ছোট ভাই শাওনকে নিয়ে মিছিলের উদ্দেশে বের হয়। বলে যায়, “মা, থাকো; দ্যাশটা স্বাধীন করে আসি।”’
সন্ধ্যায় শাওন বাড়ি ফিরে এলেও হাসপাতালের মর্গ থেকে পরদিন সিয়ামের লাশ আসে। পরে নামাজগড় গোরস্তানে দাফন করা হয়। শাপলা বেগম আরও বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় বস্তির কেউ একজন কচ্চে, পালপাড়া মোড়ে এডা ছল গুলি খায়্যা মরচে। দেখতে সিয়ামের মতো। পরে হাসপাতালত য্যায়া দেখি, হ সিয়াম-ই তো। গোটা শরীরে গুলির দাগ। চোখ–মুখ সব গুলিতে আউলে গেচে।’
সিয়ামের পালক বাবা হাড্ডিপট্টি বস্তি এলাকার গাড়িচালক মো. আশিক জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে সরকারি-বেসরকারিভাবে এ পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রসহ প্রায় ২০ লাখ টাকার সহায়তা মিলেছে।
পুলিশের করা মামলায় ভিন্ন তথ্য
গত বছরের ১৯ জুলাই বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের আমতলা মোড় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে সিয়াম নিহতের ঘটনায় ২১ জুলাই সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির আল আহসান বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেন। এতে বিএনপি ও জামায়াতের ৩৭ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা বেআইনিভাবে দলবদ্ধ হয়ে অতর্কিতভাবে কর্তব্যরত পুলিশের সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টিসহ পুলিশকে লক্ষ্য করে বেপরোয়াভাবে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও বিস্ফোরক দ্রব্য ককটেল নিক্ষেপ করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোড়া ককটেলে আসামিদের সঙ্গী সিয়ামের কপাল, মুখমণ্ডল, বুক, পেট, দুই হাত ও পা–সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম হয়। পরে স্থানীয় লোকজন সিয়ামকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই মামলার আসামি বগুড়া জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, সিয়াম–হত্যাকাণ্ড ঘটেছে প্রকাশ্যে হাজারো ছাত্র-জনতার সামনে। কার গুলিতে সিয়াম মারা গেছে, সেটার ভিডিও ফুটেজও আছে। অথচ পুলিশের করা মামলায় ককটেল বিস্ফোরণে সিয়াম মারা গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গণ–অভ্যুত্থানের পর পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বগুড়া সদর থানার ওসি হাসান বাসির। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর শাপলা বেগম তাঁর ছেলে সিয়ামকে হত্যার কথা উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ–সংক্রান্ত ঘটনায় আগেই পুলিশের করা একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হওয়ায় নতুন করে মামলার সুযোগ আছে কি না, তা মতামত চেয়ে নথি আদালতে পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আদালত মামলার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি।